বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ : নিরাপদ ফসল উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
মোঃ আসাদুল্লাহ
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি এ দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশ বিগত ৫০ বছরে খাদ্য নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করছে। মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৬০%।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়া। তাঁরই স্বপ্ন পূরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রত্যয়ে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে উন্নত জাতি গঠন করতে হবে। জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়নের মাধ্যমেই সমৃদ্ধশালী, সুস্থ জাতি গঠন করা সম্ভব। সে প্রেক্ষিতে নির্বাচনী প্রতিশ্রæতি-২০১৮ ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-তে নিরাপদ, পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সবার জন্য নিরাপদ, পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ, নিরাপদ ও চাহিদাভিত্তিক খাদ্য উৎপাদন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা জাতীয় কৃষি নীতি-২০১৮ এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি, মেধা বিকাশ ও শারীরিক গঠনে কৃষি মন্ত্রণালয় ভ‚মিকা রাখছে। কৃষি খাতে উত্তম কৃষি চর্চা (Good Agricultural Practices-GAP) যথাযথ অনুসরণপূর্বক নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ফসল উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণ ব্যবস্থায় বালাইনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক এর বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহার এবং সম্প্রসারণ কর্মকাÐের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করছে।
বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু সবজি চাষের জন্য সহায়ক। শাকসবজিতে সাধারণত বিভিন্ন খনিজ লবণ এবং ভিটামিন প্রচুর পরিমাণে থাকে। এ জন্য শাকসবজিকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। এতে ক্যালরির ও আমিষের পরিমাণ খুব কম। গাঢ় হলুদ ও সবুজ শাকসবজিতে বেশি পরিমাণে ক্যারোটিন বা প্রাক ভিটামিন ‘এ’ থাকে যা খাওয়ার পর ক্ষুদ্রান্তে ভিটামিন এ তে রূপান্তরিত হয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিদিন আহারে সবজির ব্যবহার জনপ্রিয় করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের চাষকৃত অপচলিত সবজির সংখ্যা প্রায় ৯০টি যার মধ্যে ৩০-৩৫টিকে প্রধান সবজি ধরা যায়। দেশের শতকরা ৯.৩৮ ভাগ জমি সবজি চাষের জন্য ব্যবহার হচ্ছে যার মাধ্যমে মাথা পিছু ১২৫ গ্রাম সবজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়। একজন সুস্থ সবল মানুষের জন্য প্রতিদিন ২২০ গ্রাম (সূত্র: এফএও, ডিএই) সবজি গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অপুষ্টি সমস্যা সমাধানে সুষম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে বিভিন্ন প্রকারের শাকসবজি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদন করার মাধ্যমে সারা বছরের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব।
সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবজি চাষে রাসায়নিক সার প্রয়োগ ও পোকামাকড় দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। তাছাড়া কৃষক অতি লাভের আশায় মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ করে অল্প সময়ের মধ্যে সবজি সংগ্রহ করে বিক্রি করে থাকে। সঠিক সময় না মেনে কীটনাশক প্রয়োগ ও প্রয়োগমাত্রা সম্পর্কে ধারণা না থাকার দরুন নিরাপদ সবজি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান মানুষের দেহে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টির কারণ। জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, পরিমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, উপযুক্ত সময় ও নির্ধারিত মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার এবং সঠিক সময়ে সবজি সংগ্রহের মাধ্যমে নিরাপদ সবজি উৎপাদনের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে।
উন্নত ও সুস্থ সবল বীজ, সঠিক পরিচর্যা ও জৈব প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় সব ধরনের মাটিতেই নিরাপদ উৎপাদন করা যেতে পারে। এ দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৮.৫ মিলিয়ন হেক্টর। আমরা সবজি চাষের জন্য মাত্র ৯.৩৮ ভাগ জমি ব্যবহার করছি আর এতে মাথাপিছু সবজি সরবরাহ করা যাচ্ছে মাত্র ১২৫ গ্রাম। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদন এখন বিশ্বে তৃতীয়। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে ১৩০৬৮৭৯ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ করা হয়। যেখান থেকে ২৮৯০২২৩১ টন সবজি উৎপাদিত হয়। পাশাপাশি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে সবজি রপ্তানির পরিমাণ ১৭৩০৬.৩৩৩ মেট্রিক টন (উৎস: উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং)।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে সচেতনতা
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে রাসায়নিক ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে কতিপয় বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন: ১) রাসায়নিক দ্রব্যের সঠিক ব্যবহার অনুসরণ। ২) সবজি আবাদি জমির পরিবেশকে রাসায়নিক সংক্রমণ হতে সুরক্ষা করা। ৩) সঠিক রাসায়নিক সার/কীটনাশক গ্রহণযোগ্য মাত্রায় ব্যবহার। ৪) সেচ ব্যবস্থাপনায় পানির ঝুঁকি মূল্যায়ন ও নিয়ন্ত্রণ।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে ডিএইর কার্যক্রম
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ সবজি উৎপাদনে বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি অনুমোদন করেছেন। যেমন: পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রকল্প, ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ প্রকল্প, বাংলাদেশের শাকসবজি, ফল ও পান ফসলের পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাইনাশকভিত্তিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ প্রভৃতি। যা কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সারাদেশে বছরব্যাপী নিরাপদ সবজি উৎপাদনের জন্য যা কাজ করে যাচ্ছে সেগুলো হলো- ১) নিরাপদ সবজি উৎপাদনে চাষিদের প্রশিক্ষণ প্রদান। ২) নিরাপদ সবজি উৎপাদনের কলাকৌশল হাতে-কলমে দেখানো। ৩) নিরাপদ সবজি উৎপাদনের প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ। ৪) জৈব কৃষি তথা ফেরোমন ফাঁদ, আইপিএম, আইসিএম, উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কৌশলের মাধ্যমে যথাসম্ভব জৈব বালাইনাশকের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। ৫) সঠিক সময় ও গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা। ৬) বছরব্যাপী সবজি উৎপাদন সম্পর্কে কৃষককে পরামর্শ প্রদান।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনে করণীয়
অনিরাপদ সবজি পুষ্টির পরিবর্তে মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ ছড়াচ্ছে এবং দেশের বাইরে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি করছে। নিরাপদ সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাসায়নিক ব্যবহার পরিহার করতে হবে যেন মাটি, পানি ও বায়ু দূষণ না হয় এবং কৃষক ভাইদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা হয়। তাই আইপিএম, আইসিএম, উত্তম কৃষি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির স¤প্রসারণে জোর দিতে হবে। মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য জমিতে জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া কম্পোস্ট সার, কেঁচো সার ইত্যাদি প্রয়োগ করলে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বালাইনাশকের ক্ষেত্রে নিম, নিশিন্দা, বিষকাটালী ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কৃষকের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে না।
পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে কাক্সিক্ষত নিরাপদ ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষির আধুনিকায়নে ডিজিটাল সেবাসমূহ (লক্ষণ দেখে রোগবালাই নির্ণয়, নিরাপদ বালাইনাশক ব্যবহার, অনলাইন বা অফলাইন সার সুপারিশ, কৃষি কল সেন্টার) কৃষককে প্রদান করা হয়েছে। সেসাথে মাঠপর্যায়ে আইপিএম কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার ক্রমাগত কমার ফলশ্রæতিতে ২০১৮ সালে কীটনাশকের ব্যবহার ছিল ৩৯২৩৭.০০ মে. টন/কিলোলিটার। ২০১৯ সালে ব্যবহার হয়েছে ৩৮৩৬৯.০০ মে.টন/কিলোলিটার। যা পূর্বের বছরের তুলনায় ৯১৪.২২ মে. টন/ কিলোলিটার কম। তাছাড়া সম্প্রতি ৪৪টি জৈব বালাইনাশকের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে এবং ১১টির রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ক্যাবি এর সহায়তায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ২০টি উপজেলায় সর্বমোট ৩০টি প্লান্ট ডক্টরস ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রায় ৭,০০০ জন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৪,৬৮২ জন কৃষককে উদ্ভিদ সংরক্ষণ সম্পর্কিত সেবা প্রদান করা হয়েছে। বালাই ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মাধ্যমে ধান, গম, ভুট্টা, শাকসবজি প্রভৃতি ফসলে প্রচলিত ও নতুন নতুন পোকা/রোগ যেমন: গমে বøাস্ট, ভুট্টায় ফল আর্মিওয়ার্ম প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ফেঁরোমন ফাঁদ ব্যবহার, ফ্যাক্টসিট সরবরাহ, আইপিএম পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে।
নিরাপদ সবজি উৎপাদনকারী কৃষকের বাজার অনুপ্রবেশ
কৃষকের বাজার অনুপ্রবেশ মূলত বাধাগ্রস্ত হয় পরিবহণ, অবকাঠামো এবং গুণগত স্ট্যান্ডার্ড দ্বারা। উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ কৃষকেরই নিজস্ব পরিবহণ না থাকায় স্থানীয় বাজারের বাইরে পণ্য নিয়ে যেতে পারেন না। অধিকন্তু কৃষকের নেই ফসল সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো, যেমন-হিমায়িত বা শীতক সুবিধাবলি, যার ফলে পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায় এবং ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয় হয়। এসব বাধাসমূহের জন্য কৃষক বড় ব্যবসায়ী বা রপ্তানিকারকের সঙ্গে সরাসরি অংশীদারিত্বে যেতে পারেন না, কারণ ব্যবসায়ী বা রপ্তানিকারকের প্রয়োজন পণ্যের ভৌতিক গুণাবলি এবং পরিমাণ। ফলে কৃষক তাদের এলাকার বাইরের বাজার অংশীদারদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন না এবং কৃষক তার এলাকার বাইরের বাজারের পণ্য মূল্য ও চাহিদা সম্পর্কে সজাগ থাকেন না। এভাবেই কমে যায় কৃষকের মুনাফা। কৃষকদেরকে বাজারে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্য দুটি। ১) কৃষকদেরকে ভোক্তার চাহিদা সম্পর্কে তথ্য দেয়া, কি ধরনের পণ্য তারা পছন্দ করে এবং কোনপর্যায়ের গুণাবলি তারা পছন্দ করে। ২) তাদেরকে ক্রেতাদের পছন্দের পণ্য সরবরাহ করার সামর্থ্য বৃদ্ধি করে অধিক মুনাফা অর্জনে সহায়তা করা।
পরিশেষে মুজিববর্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সাফল্য কামনা করে দেশের জনগণের দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার টেকসই রূপ দিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা ব্যক্ত করছি।
মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকা-১২১৫, ফোন : ৯১৪০৮৫০, ই-মেইল : dg@dae.gov.bd